রোজা ধর্মীয় এবং আত্মিক উন্নয়নের পাশাপাশি স্বাস্থ্যরক্ষায় অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে
আমি খুবই ভগ্ন স্বাস্থ্যের একজন মানুষ। একসময় ধারণা ছিলো রোজা রাখলে আমার শরীর আরো খারাপ করবে। দীর্ঘদিন সে কারণে রোজা রাখিও নি। কিন্তু এখন আত্মিকভাবেই রোজা রাখার প্রয়োজন অনুভব করছি। সেইসাথে পেপারে প্রায়ই দেখি রোজা রাখলে নাকি শরীরের জন্যেও উপকার। ব্যাপারটা একটু বুঝিয়ে বলুন।
আপনি ঠিকই শুনেছেন। রোজা ধর্মীয় এবং আত্মিক উন্নয়নের পাশাপাশি স্বাস্থ্যরক্ষায় অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
গবেষণায় দেখা গেছে, যখন কোন ব্যক্তি স্বাভাবিক খাদ্য তালিকা অনুসরণ করে রোজা রাখে, তখন শরীর থেকে বিষাক্ত ও চর্বি জাতীয় পদার্থের অপসারণ ঘটে এবং একই সাথে প্রাকৃতিক ফলমূল গ্রহণ করার ফলে তা শরীরের ভিটামিন ও মিনারেলের চাহিদা পূরণ হয় যা শরীরের রোগ প্রতিরোধে সাহায্য করে।
মধ্যপ্রাচের একদল কার্ডিওলজিস্ট বলেছেন যে যারা রমজানে রোজা রাখেন তাদের রক্তে কোলেস্টেরল এর পরিমাণ কমে যায়। ফলে নানা ধরণের হৃদরোগ যেমন হার্ট আটাক, স্ট্রোক ইত্যাদির ঝুঁকিও কমে যায়। আর যদি রমজানের পরেও সুষম এই খাদ্যাভ্যাস চালু রাখা যায়, তবে কোলেস্টেরলের মাত্রা বাড়ার কোনো সম্ভাবনাই থাকবে না। সেই সাথে দেহের ওজন নিয়ন্ত্রণ করাটাও সহজ হয়।
পাউরুটি-বিস্কুট, কেক বা পিজা-র মতো খাবার খাওয়ার পর দেহের ভেতর এগুলো টক্সিনে রূপান্তরিত হয়। এমনকি কোনো কোনো সময় তা এডভান্সড গ্লাইসেশন এন্ড প্রোডাক্ট (Advanced Glycation End product বা AGE) এ রূপান্তরিত হয়। আমরা জানি বয়স এবং ডায়াবেটিসের কারণে মানুষের যে দুরারোগ্য ব্যাধিগুলো হয়, যেমন, অ্যাজমা, আথ্রারাইটিস, হার্ট অ্যাটাক, কিডনি ফেইলিওর, দৃষ্টিশক্তি হারানো, দাঁত পড়ে যাওয়া, মস্তিষ্কের ক্ষমতা কমে যাওয়া – ইত্যাদির পেছনে মূল কারক হলো এই AGE। রোজাতে দীর্ঘ সময় না খেয়ে থাকার ফলে এই ফ্যাট কমে এবং ক্ষতিকারক টক্সিনগুলো লিভার, কিডনি ও অন্যান্য অঙ্গের মধ্য দিয়ে রেচনের মাধ্যমে বেরিয়ে যায়।
রোজা রাখলে পরিপাকতন্ত্রের বিশ্রাম হয়। দেহের যে অঙ্গপ্রত্যঙ্গগুলো খাবার হজমের কাজ করে, রোজার সময় তারা একটা বিরতি পায়। হজমের রস নিঃসরণটা তখন ধীর হয়। খাবারগুলোও ভাঙে ধীরে। দেহে তরলের ভারসাম্য বজায় রাখতে এটা খুব সহায়ক। দেহের জন্যে প্রয়োজনীয় শক্তিও তখন নিঃসরণ হয় ধীরে।
অবশ্য রোজা রাখলেও পাকস্থলীর এসিড নিঃসরণ বন্ধ হয় না। এজন্যেই পেপটিক আলসারের রোগীদের রোজা রাখার ক্ষেত্রে ডাক্তাররা কিছুটা সতর্কতা অবলম্বন করতে বলেন।
বলা হয়, ওষুধ ছাড়া রক্তচাপ কমাবার এক আদর্শ পদ্ধতি রোজা। কারণ রোজা রাখলে প্রথমে গ্লুকোজ, পরে চর্বিকণাগুলো ক্ষয় হয়ে শক্তি উৎপাদন করে। রোজা রাখলে মেটাবলিক রেটও কমে। এড্রিনালিন এবং নরএড্রিনালিনের মতো স্ট্রেস হরমোন উৎপাদন কমে। আর এতে করে মেটাবলিক হার একটা স্বাভাবিক মাত্রায় থাকে। ফলে ব্লাড প্রেশার কমে। আর এর ইতিবাচক প্রভাব পড়ে এথেরেসক্লেরোসিস বা ধমনীতে চর্বি জমার প্রক্রিয়ার ওপর যা হার্ট এটাকের ঝুঁকি কমায়।
রোজা রাখাকালীন একজন মানুষের দেহের গ্লুকোজগুলো দ্রুত ভাঙতে থাকে এবং দেহের জন্যে প্রয়োজনীয় শক্তি উৎপাদন করে। ফলে তখন ইনসুলিনের উৎপাদন কমে যায় যা প্যানক্রিয়াসকে কিছুটা বিশ্রাম দেয়। অন্যদিকে গ্লুকোজ ভাঙার সুবিধার্থে গ্লাইকোজেন তৈরি হয় আর এ সবকিছুর সম্মিলিত ফলাফল হলো দেহে ব্লাড সুগারের পরিমাণ কমানো যা ডায়াবেটিস প্রতিরোধে সহায়ক।
জীবাণু বা আঘাতজনিত কারণে দেহ যে প্রক্রিয়ায় অসুস্থ হয়, গবেষণায় দেখা গেছে রোজা সে প্রক্রিয়াকে নষ্ট করে দেয়। ফলে রিউমাটয়েড আর্থ্রারাইটিস, এলার্জি, সোরিয়াসিস নামক চর্মরোগ ইত্যাদি থেকে নিরাময়ে রোজার ভূমিকা আছে বলে মনে করেন চিকিৎসাবিজ্ঞানীরা। কোনো কোনো বিশেষজ্ঞের মতে, পিত্তথলির রোগ আলসারেটিভ কোলাইটিস নিরাময়েও রোজার ভূমিকা আছে।
অনেকেরই অনেক ধরনের খারাপ অভ্যাসের প্রতি আসক্তি থাকে, যেমন-ধুমপান করা, অতিরিক্ত চিনি জাতীয় খাবার খাওয়া ইত্যাদি। রমজানে সারাদিন খাওয়া-দাওয়া থেকে বিরত থাকায় অনেক ধরণের বাজে অভ্যাস থেকে দূরে সরে আসা সহজ হয়। একটানা কয়েকদিন বিরত থাকলে স্বতঃস্ফূর্তভাবেই সেই অভ্যাসটা ত্যাগ করা যাবে। সবচেয়ে ভালো হয় যদি এ কাজটা সংঘবদ্ধভাবে করা যায়। যুক্তরাজ্যের ন্যাশনাল হেলথ সার্ভিস রমজান মাসটাকে ধুমপান ছেড়ে দেবার জন্য আদর্শ সময় বলে আখ্যায়িত করেছে।
আমেরিকার একদল বিজ্ঞানী গবেষণা করে দেখেছেন যে রমজানে রোজা রাখার মাধ্যমে মস্তিষ্কে নতুন নতুন কোষের জন্ম হয়। ফলে মস্তিষ্কের কর্মদক্ষতা বেড়ে যায়। অন্যদিকে কর্টিসল নামক একধরণের হরমোন যা আড্রিনালিন গ্রন্থি থেকে নিঃসরিত হয়, তার পরিমাণ কমে যায়। ফলশ্রুতিতে পুরো রমজান মাসে এবং রমজানের পরেও মানসিক চাপ বেশ কম থাকে।
- Posted in: Uncategorized
Recent Comments